নিউজ ডেস্কে নিরাপত্তার ঘাটতির কথা আগে জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কক্ষ থেকে গায়েব হয় নথি
সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কক্ষ থেকে গায়েব হয় নথিছবি: প্রথম আলো
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের যে কক্ষ থেকে ১৭টি নথি চুরি হয়েছে, সেখান থেকে এর আগে একবার নথি গায়েব হয়েছিল। তখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই কক্ষের নথিপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে লিখিতভাবে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নাম না প্রকাশের শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে নথি চুরির ঘটনা উদ্বেগজনক। ভেতরের কেউ জড়িত না থাকলে নথি গায়েব করা কঠিন। জানানোর পরও আগে নথির নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় একই ঘটনা আবার ঘটল। এর দায় এড়াতে পারেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কেনাকাটাসংক্রান্ত ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের বিষয়টি নজরে আসার পর পর গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের নিচতলায় ২৯ নম্বর কক্ষ থেকে এসব নথি খোয়া যায়। ছোট্ট এই কক্ষে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের চারটি শাখার কার্যক্রম একসঙ্গে চলে। শাখাগুলো হলো ক্রয় ও সংগ্রহ-২ শাখা, উন্নয়ন অনুবিভাগ, চিকিৎসা শিক্ষা অধিশাখা এবং পত্র গ্রহণ ও বিতরণ (ডেসপাস) শাখা। চারটি শাখার ১৩ জন কর্মচারী গাদাগাদি করে বসেন এই কক্ষে। এর মধ্যে ক্রয় ও সংগ্রহ-২ শাখার ১৭টি নথি গায়েব হয়েছে। একটি স্টিলের ফাইল কেবিনেটে (আলমারি) নথিগুলো রাখা ছিল। কক্ষটিতে ক্রয় ও সংগ্রহ-২ শাখার দুজন কর্মচারী বসতেন। কিন্তু এই শাখার কর্মকর্তারা বসেন ভবনের ওপরের তলায়। ফলে ওই দুই কর্মচারীর হাতেই ছিল মূলত গুরুত্বপূর্ণ এসব নথির তদারকির দায়িত্ব।
মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ওই কক্ষে নথিপত্র রাখায় নিরাপত্তায় ঘাটতির বিষয়টি ক্রয় ও সংগ্রহ-২ শাখার কর্মকর্তাদের নজরে আরও আগেই এসেছিল। বেশ কিছু দিন আগে কর্মকর্তাদের পরিদর্শনেও এই ঘাটতির বিষয়টি উঠে আসে। এ জন্য তখন এই শাখার পক্ষ থেকে নথিপত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া ওই কক্ষ থেকে এর আগেও একই শাখার নথি চুরির ঘটনা ঘটেছিল। তখন ওই কক্ষে ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর দায়িত্বে থাকা সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর আয়েশা সিদ্দিকাকে অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। তাঁর নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও শাখার পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল চুরির ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এ ঘটনায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। আজ মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিয়েছেন।
এদিকে সবশেষ নথি চুরির ঘটনায়ও আয়েশা সিদ্দিকাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁর সঙ্গে ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর আরেক সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদারকেও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব প্রথম আলোকে বলেন, যে নথিগুলো চুরি হয়েছে সেগুলো হয়তো বিকল্প অনুলিপি আছে। কিন্তু এভাবে সরকারি নথি চুরি হয়ে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগের।
আরও তিনজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েছে সিআইডি
এদিকে নথি চুরির ঘটনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের আরও তিনজন কর্মচারীকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি। তাঁরা হলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা অহিদ খান, প্রশাসন শাখার কর্মচারী সেলিম এবং বাজেট শাখার হাবিব। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নাসিমুল গণি নামে স্বাস্থ্য খাতের এক ঠিকাদারকে গতকাল সোমবার রাতে রাজশাহী থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে সিআইডি। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চুরি হওয়া নথির মধ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেনাকাটাসংক্রান্ত নথিও রয়েছে। অবশ্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
নাসিমুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী থেকে ঢাকায় আনার পর সিআইডি কার্যালয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
চুরির ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ছয় কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাঁদের বিভিন্ন কার্যক্রমের খবর নিচ্ছে সিআইডি। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় মোট ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বা করছে সিআইডি।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম বিভাগ) মো. আজাদ রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, নথি চুরির ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের ৯ কর্মচারীর বিরুদ্ধে আজ রাত পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। তাঁদের আটকও করা হয়নি। তবে ঘটনায় রহস্য উদ্ঘাটনে সিআইডি হেফাজতে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
নথি চুরির ঘটনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) শাহ্ আলমের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করেছে মন্ত্রণালয়। এই কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে যাঁদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, তাঁরা এখন সিআইডি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আছে। এ অবস্থায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। তাই নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে কি না, সেটি বলা যাচ্ছে না।