‘ভাই, এখানে এক চাইনিজ এজেন্টের কাছে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) না দিলে বের হতে দেবে না। কাল অনেক মারধর করেছে। ভাই, আপনি কি সাহায্য করতে পারবেন? একটু চেষ্টা করেন, বের করতে পারেন কি না। যদি পারেন আমার অনেক উপকার হয়।’
চলতি বছরের (২০২২) আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কম্বোডিয়ার নম পেন শহর থেকে সেখানকার এক চীনা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীর পাঠানো বার্তাটি আসে স্বাধীনবাংলা টিভির কাছে। ওই বার্তার সূত্র ধরে কথা হয় ওই কর্মীর সঙ্গে। উঠে আসে কম্বোডিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতনের রোমহর্ষক চিত্র।
ভুক্তভোগী ওই যুবকের পাশাপাশি কম্বোডিয়ায় থাকা আরও প্রায় ২০ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় স্বাধীনবাংলা টিভির। তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে কম্বোডিয়ায় এনে বিক্রি করা হয় তাদের। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি দালাল ফারুক (আব্দুল্লাহ আল ফারুক), অপু (আব্দুল্লাহ আল মামুন) এবং আলম সহ আরো অনেকেই । চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো কেনার পর তাদের ‘দাস’বানিয়ে রাখে। বাধ্য করা হয় নানা অপকর্ম করতে। তাদের কথামতো সবকিছু করতে হয়। না করলে চলে নির্যাতন।
তারা জানান, প্রথমে বাংলাদেশি গ্রাম্য দালাল এবং অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে তরুণ যুবকদের টার্গেট করে তাদের উচ্চ বেতনের চাকরির স্বপ্ন দেখিয়ে ফাদে ফেলে ফারুক, আলম এবং অপু। বিশেষ করে তাদের মূল টার্গেট সদ্য ভার্সিটি পাসকৃত ফ্রেশার বেকার যুবকরা। এরপর তাদের নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে জন প্রতি ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকা নেওয়া হয় বিদেশে (কম্বোডিয়া) যাওয়ার খরচ বাবদ। উচ্চ বেতন এবং ভালো চাকরির আশায় যুবকদের পরিবারও রাজি হয়ে যায় সহজেই, এটাই এই প্রতারকদের মূল পুজি।
এরপর কিছু দিনের মধ্যেই চলে আসে ভিসা। যুবকদের এবং তাদের পরিবারের মুখে দেখা যায় আশার আলো, কিন্তু এর আলো যে কতবড় অন্ধকার বয়ে আনবে এটা তখনো সবারই অজানা। কাউকে দেওয়া হয় ট্যুরিস্ট ভিসা, আবার কাউকে বিজনেস ভিসা। তারপর কিছু অসাধু এয়ারপোর্ট কর্মকর্তার সাহায্যে তাদের পাচার করা হয় কম্বোডিয়ায়। কম্বোডিয়ায় পৌঁছানোর পর নম পেন এয়ারপোর্টে তাদের রিসিভ করতে কখনো অপু, কখনো ফারুক, আবার কখনো আলম আসেন। তাদের নিয়ে তোলা হয় অপুর ভাড়া করা বাসায়, কখনো ফারুকের বাসায়, আবার কখনো কোনো হোটেলে।
রাতভর অপুর অফিসে চলে চাদের বিক্রি করার প্রস্ততি জানান, দাসত্য থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া যুবক সাকিব হাসান। এরপর অপুর অফিসে এবং অপুর চাইনিজ বসের (দাস ক্রেতা) অফিসে চলে অনলাইন স্ক্যামিং এবং প্রতারণার ২০ দিনের বিশেষ ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষে জনপ্রতি ৪-৫ হাজার ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় ৪৪০,০০০/- থেকে ৫৫০,০০০/- + টাকা) বিনিময়ে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় চাইনিজ স্ক্যামার মিঃ কিম অথবা অপুর চাইনিজ স্ক্যামার বস তথা পার্টনারদের কাছে। বাংলাদেশিদের কেনার পর নানা ধরনের প্রতারণামূলক কাজে লাগায় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। চাইনিজদের জেল বন্দী স্ক্যামিং প্লাটফর্মের ভিতর যাওয়ার পরই বুঝতে পারেন তারা উচ্চ বেতনের চাকরির আশায় কিছু নর-পিচাশের হাত ধরে নরকে এসে পৌঁছেছেন।
কোম্পানিতে যাওয়ার পরই তাদের উপর শুরু হয় অমানষিক অত্যাচার-নির্যাতন। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় তাদের এবং তাদের পরিবারের স্বপ্ন। মাথায় ভেঙ্গে পড়ে আকাশ, এ কোন পাপের সুমুদ্রে এসে পড়লাম বলে মাথা আছড়াতে থাকেন তারা।
মুক্তিপণ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন এমন তিন বাংলাদেশি হলেন সাকিব, সাদমান ও রবিন (অনুমতি নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করা হলো)। তারা জানান, তারা তিন বন্ধু, একই এলাকায় বসবাস। হঠাত একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখতে পান উচ্চ বেতনে বিদেশে লোভনীয় চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন, বেশ কৌতূহলী মেসেজ করেন বিজ্ঞাপনদাতার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে, ফেসে যান ফারুক, আলম এবং অপুর জালে। দালালদের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তাদের পরিবারও, সরাসরি কম্বোডিয়া থেকে চাকরির অফার পেয়ে একধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। দালালরা এতটাই তাড়াহুড়া করেছিল যে সন্দেহ করার সুযোগই দেননি।
এরপর পুরান ঢাকায় তাদের একজন এজেন্টের (ডিএইচএল তথা কুরিয়ার কর্মী) কাছে পাসপোর্ট দিয়ে আসতে বলে। দেখানে পাসপোর্ট দিয়ে আসার ৭ দিনের মাথায় তাদের ভিসা চলে আসে, বিজনেস ভিসা। তখন ফারুককে বিজনেস ভিসা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি জানান এখানে (কম্বোডিয়াতে) আসলে ওয়ার্ক পার্মিট করে দেওয়া হবে। লেন-দেন চলে ফারুকের মানি লন্ডারিং ব্যবসার হুন্ড্রির ব্যাংক একাউন্টে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে ‘কম্পিউটার অপারেটর’ হিসেবে চাকরি নিয়ে তারা কম্বোডিয়া যান। তাদের এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে অপু, ফারুক এবং আলম। অপুর গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় অপু এবং ফারুকের রাজধানী নম পেন এর ইউরোপিয়ান সিটির বাসাতে, আলম এয়ারপোর্ট থেকেই বিদায় নিয়ে চলে যায়।
সেখানে তারা কয়েকজন চাইনিজকে নিয়মিত দেখতে পান। কয়েকদিন পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানী নম পেন এর অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে, সেখানে চাইনিজদের মাধ্যমে তাদের ২০ দিন বিশেষ স্ক্যামিং এবং প্রতারণার ট্রেনিং দেওয়া হয়। মূলত বিক্রির আগে ফারুক এবং আলমই এই বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে থাকেন ভালো দাম পাওয়ার আশায়। টাইপিং, ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষ ছিলেন তারা তাই ভালো দাম পেতে কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি অপু-ফারুক-আলমদের। ট্রেনিং শেষে প্রত্যেককে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মার্কিন ডলারে মিঃ কিম নামের এক চাইনিজের একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে এক বছরের জন্য বিক্রি করে দেন বাংলাদেশি দালাল অপু, ফারুক ও আলম ।
তারপর তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে একটি বৃহৎ কক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ ডেস্কটপ কম্পিউটার সাজানো থাকে। মানবপাচারকারীদের ভাষায় ওই ল্যাবকে ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।
স্ক্যামের ধরনঃ প্রথমে আমাকে যুক্তরাজ্যের লিবারপুল প্রদেশের একজন ডাক্তার পরিচয়ে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। ওই অ্যাকাউন্টে আমার নাম দেওয়া হয় লেও থমাস। প্রোফাইলে ছবি দেওয়া হয় একজন সুদর্শন ও সাদা চামড়ার যুবকের। বয়স দেখানো হয় ২৬ থেকে ২৮ বছর। আমি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে নিয়মিত ওই ছেলের ছবি পোস্ট করতাম। ট্রেন্ডিং, ফুটবল, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে পোস্ট দিয়ে অ্যাকাউন্ট সচল রাখতাম এবং প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি মেয়েকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতাম।
“যারা একসেপ্ট করত তাদের প্রথম পাঁচ-ছয়দিন শুধু ‘গুড মর্নিং’, ‘গুড নাইট’সহ নানা গ্রিটিং মেসেজ পাঠাতাম। একপর্যায়ে কেউ যদি রিপ্লাই দিত তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম।
মাসখানেকের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার দুটি এবং মালয়েশিয়ার একটি মেয়ে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। আমরা নিয়মিত চ্যাট ও কল করতাম। একে অন্যকে নগ্ন ও আপত্তিকর ছবি পাঠাতাম। মেয়েদের সারা শরীরের ছবি থাকলেও আমার ছবিতে কোনো মুখ থাকত না। সম্পর্কের দ্বিতীয় মাসে আমি চীনা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে অন্য একটি আইডি খুলে ওই তিন মেয়ের কাছে ঘনিষ্ঠ ও আপত্তিকর ছবিগুলো পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করি। তাদের কাছ থেকে প্রায় আট হাজার মার্কিন ডলার আদায় করি।
বর্তমানে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন বিক্রির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি স্ক্যামিং করছে— অভিযোগ করেন তিনি।
ফারুক-অপুর নিজস্ব স্ক্যামিং প্লাটফর্ম
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ফারুক এবং অপু রাজধানী নমপেন এ বাসা ভারা করে চালাচ্ছে বাংলাদেশি প্ল্যাটফর্ম। লুটে নিচ্ছে নিরীহ বাংলাদেশিদের লক্ষ লক্ষ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছা শর্তে ফারুক-অপুর ফ্লাটফর্মের একজন কর্মী জানান, তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে বেশ কয়েকটি জুয়া বা বেটিং ওয়েবসাইট, ঋণ প্রতারণার ওয়েবসাইট এবং কিছু বিটকয়েনের ওয়েবসাইট পরিচালনা করা হয়ে থাকে। সব ধরনের সফটওয়্যার এবং ওয়েবসাইট সর্বরোহ করে থাকে অপুর দুই চাইনিজ বস তথা পার্টনার । এসব জুয়ার সাইটের মাধ্যমে তরুন সমাজকে আসক্ত করে তাদের পরিবারকে লুটেপুটে করে দেওয়া হচ্ছে নিঃস্ব। তাদের মূল টার্গেট স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
তারা ওয়েবসাইট বানিয়ে মানুষকে ঋণ দেওয়ার নামেও চুষে খাচ্ছে রক্ত। এ কাজে হতাশাগ্রস্ত ও অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। আবার কখনও যেসব ব্যক্তি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন বা ঋণ নিতে ইচ্ছুক, এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের কম সুদে আকর্ষণীয় ঋণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে রাজি হলে ডিপোজিট বাবদ ৫ শতাংশ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। অর্থ আত্মসাৎ করার পর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রাথমিক ভাবে কিছু বিকাশ একাউন্টে এবং কিছু ভাড়া করা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে ওয়েবসাইটের জুয়ার টাকা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পরে কম্বোডিয়াতে ফারুকের ঘনিষ্ট কিছু প্রভাবশালী হুন্ড্রি তথা মানি লন্ডারিং ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সেই টাকা বাংলাদেশ থেকে কম্বোডিয়াতে পাচার করা হয়।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের দায়িত্ত ফারুক এর, এবং প্লাটফর্ম তথা ক্যাসিনো দেখাশুনা করার দায়িত্ত অপু এবং অপুর চাইনিজ বসদের। ২ জন চাইনিজ এবং অপু-ফারুক মিলে সম্পুর্ণ ক্যাসিনো পরিচালনা করে থাকেন। তাদের কর্মী সংখ্যা ১৮-২০ জন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১৫-২০ কোটি টাকা তারা কম্বোডিয়াতে পাচার করেছে বলে ধরণা করা হয়। তাদের ক্যাসিনোতে কর্মরত সকল বাংলাদেশিদের তারা জিম্মি করে রেখেছে। তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে, সাদা কাগজে আঙ্গলের ছাপ নিয়ে নানা ভাবে কর্মীদের ব্ল্যাকমেইল করে জোর পূর্বক তাদের দিয়ে এই প্রতারণার কাজ করা হচ্ছে হবে জানান সম্প্রতি তাদের নরক থেকে মুক্তি পাওয়া এক ভূক্তভূগি।
বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার সেল জানায়, তারা এতদিন ধারণা করে আসছিলো এই জুয়া এবং প্রতারণার সাইট গুলো রাশিয়া থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে, কিন্তু সম্প্রতি তারা প্রমান পেয়েছে অধিকাংশ জুয়ার এবং প্রতারণার সাইটই কম্বোডিয়া থেকে পরিচালনা হচ্ছে, এবং এর সাথে কতিপয় বাংলাদেশি প্রতারক জড়িত। ইতোমধ্যেই তারা একটি লিস্ট করে কম্বোডিয়া পুলিশের ইন্টারপোল ডিপার্মেন্টের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারা খুব শিঘ্রই কঠোর প্রদক্ষেপ নিবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ইতো মধ্যে কম্বোডিয়া প্রশাসন স্ক্যামিং বা প্রতারণাচক্র বিরোধী অনেক প্রদক্ষেপই বাস্তবায়ন করেছে বলে জানা গেছে।
দাস কেনার চুক্তিপত্রে যা থাকে
বিক্রির সময় ফারুক, অপু, আলম ও কর্মীদের (ভিক্টিমদের) মধ্যে একটি চুক্তিপত্র/অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর হয়। সেখানে চীনা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তারিখ উল্লেখ থাকে। তার নিচে বাংলাদেশি কর্মীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, জন্ম তারিখ, বাংলাদেশের ঠিকানা, এজেন্টের (দালাল) নাম, চুক্তির মেয়াদকাল, কর্মঘণ্টা এবং কত টাকা দিয়ে (মার্কিন ডলার) বাংলাদেশিকে কেনা হয়েছে সেসব বিষয় উল্লেখ থাকে।
স্বাধীনবাংলা টিভি এ ধরনের একটি চুক্তিপত্র সংগ্রহ করেছে। এতে কর্মীকে দিয়ে কী কাজ করানো হবে তা উল্লেখের পাশাপাশি ওই কাজ করতে তিনি বাধ্য থাকবেন, তা উল্লেখ থাকে। তবে, চুক্তিপত্রটি বাংলাদেশি কর্মীকে পড়তে দেওয়া হয় না। তারা কেবল স্বাক্ষর দেন।
অঙ্গীকারনামায় যেসব বিষয় উল্লেখ থাকে তা হচ্ছে— স্বাক্ষরকারী ওই কর্মী এক বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এবং প্রতিষ্ঠানের সব শর্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। তাকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজের টার্গেট দেওয়া হবে। সেই টার্গেট পূরণ করতে না পারলে বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ (টিম লিডারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে) ওই প্রতিষ্ঠান কেটে রাখবে। চাকরির প্রথম এক বছর তারা অফিস ভবন থেকে বের হতে পারবেন না। কাজের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। কেউ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের টার্গেট পূরণ না করেই কাজ ছেড়ে চলে যেতে চান তাহলে তাদের সেই মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা কেটে রেখে দেওয়া এবং তাদের কিনতে যত টাকা খরচ হয়েছে সেই অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
এতে আরও উল্লেখ আছে, কোনো কর্মী যদি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠান চাইলে যেকোনো কর্মীকে যেকোনো সময় অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে।
অঙ্গীকারনামার শেষ অংশে লেখা রয়েছে, ‘আমি ঘোষণা করছি, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে এবং কারও প্ররোচনা ছাড়াই স্বাক্ষর করলাম।’ তবে, স্বাধীনবাংলা টিভিকে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, চুক্তির বিষয়বস্তুগুলো তাদের পড়তে দেওয়া হয় না। এছাড়া ইংরেজিতে লেখা থাকায় অনেকেই তা পড়ার আগ্রহ দেখান না।
ভূক্তভূগি সাদমান জানান , আমি ১২ ঘণ্টা নাইট ডিউটি করতাম। টানা আট ঘণ্টা ডিউটির পর ৩০ মিনিটের জন্য খাবারের বিরতি দেওয়া হতো। এরপর আবারও কাজ। একবার ডিউটি করা অবস্থায় রাতে শুয়ে পড়েছিলাম। তারা স্পাইক কেডস দিয়ে আমার পিঠে লাথি মারে। ব্যথায় কাতরাতে থাকি, তারপরও লাথি দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি এবং কম্পিউটারের সামনে কাজ করতে বসি। নিয়মিত কিল-ঘুষি, লাথি ও গালিগালাজ চলত সেখানে।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ও ভিডিও দেখে জানা যায়, বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ইলেকট্রিক শক।
ভুক্তভোগীরা জানান, কেউ যদি টানা দুই-তিনদিনের টার্গেট পূরণ করতে ব্যর্থ হন অথবা বারবার বাড়ি ফিরতে চান তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। প্রথমে তাদের লোহার পাইপ বা রডের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। তাদের কোমরের নিচে লাঠি বা রড দিয়ে পেটানো হয়। পাশাপাশি পুরুষাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। ক্রিকেট বা বেজবল ব্যাট দিয়েও পেটানো হয়।
‘প্রতিটি রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং কন্ট্রোল রুম অপারেটর থাকে। রাতে কেউ ঘুমালে তাকে ব্যাট দিয়ে পেটাতে দেখেছি আমি। অনেকে শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদত। তাদের মুখে কাপড় ঢুকিয়ে আরও তীব্রভাবে পেটানো হতো। আমার এক রুমমেট সাতদিন রুমে ফেরেনি। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে মেরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে, আমরা সঠিক তথ্য জানতে পারিনি। বিষয়টি রহস্যই থেকে গেছে।’
কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোম্পনি তাদের মুক্তি না নিয়ে নতুন কোম্পানির কাছে ৩৫০০ ডলারে আবার বিক্রি করে দেয়। সাকিব জানায়, এ বিষয়ে সাহায্যের জন্য ফারুক, অপু এবং আলমের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলে, “কাজ করতে এসেছিস কাজ করবি, এর কথা কিসের? তোদের কি বসিয়ে বেতন দিবে? বের হতে চাইলে বাবাকে বল টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে তোদের পিছনে কোম্পানির অনেক টাকা খরচ হয়েছে, গ্রুপিং করলে তোদের লাশও দেশে যাবে না”।
সাকিব বলে যথাক্রমে আমরা সবার সাথেই যোগাযোগ করি, কিন্তু সবাই একই রকম উত্তর দেয়। তখন নিজেদের পৃথিবীর সবথেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। তারপর আমরা জীবন বাঁচাতে বাড়িতে যোগাযোগ করি। মুক্তিপণ বাবদ জনপ্রতি ৩০০০ ডলার করে বাংলাদেশ থেকে এনে দিয়ে নরক থেকে বের হতে পেরেছি। পরে জানতে পারলাম শেষবারও আমাদের বিক্রির টাকা থেকে তারা ২০০০ ডলার করে কমিশন নিয়েছে।
খোজ নিয়ে দেখা যায় ফারুক, অপু এবং আলম, তিনজনই প্রায় অর্ধ-যুগ ধরে দেশ ছাড়া। এবং এদের বিরুদ্ধে এশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশেও মামলা রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশে প্রতারণা, মানবপাচার, এমএলএম সহ একাধিক মামলার আসামি।
ইতোমধ্যে তাদের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজন মানবপাচারকারি বাংলাদেশে গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশের আশ্বাস অতি শিঘ্রই তাদের বিরোদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।